সালাতে একাগ্রতা ও খুশু-পর্ব ২
খুশু সৃষ্টি ও শক্তিশালী করণের উপায়সমূহ
এক. সালাতের জন্য প্রস্ততি গ্রহণ ও তৈরী হওয়া। যেমন, মুয়াজ্জিনের সাথে সাথে আজানের শব্দগুলো উচ্চারণ করা এবং আজান শেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত নিম্নোক্ত দোয়া পড়া।.
“আল্লা-হুম্মা রাব্বা হা-যিহিদ দা’ওয়াতিত তা-ম্মাতি ওয়াস সালা-তিল ক্বা-‘ইমাতি,’আ-তি মুহাম্মাদানিল ওয়াসীলাতা ওয়াল ফাদ্বীলাতা,ওয়াব ‘আসহু মাক্বা-মাম মাহ্মুদানিল্লাযী ওয়া‘আদতাহু [ইন্নকা লা-তুখলিফুল মী’আদ]
অর্থঃ হে আল্লাহ্! এই পরিপূর্ণ আহবান এবং এই নামাযের তুমিই প্রভূ।হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দান কর সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান,সুমহান মর্যাদা এবং বেহেশতের শ্রেষ্টতম প্রশংসিত স্থানে তাঁকে অধিষ্ঠিত কর যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাঁকে দিয়েছ।নিশ্চই তুমি প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করনা।
আজান-ইকামতের মাঝখানে দোয়া করা, বিসমিল্লাহ বলে পরিশুদ্ধভাবে ওজু করা, ওজুর পরে দোয়া পড়া। যেমন,
“আশ হাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লা হু ওয়া আশ হাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আব্দুহু ওয়া রাসুলুহু।আল্লাহুম্মাজ’আলনি মিনাত তাওয়্যাবিনা ওয়াজ’আলনি মিনাল মুতাহহিরীনা।“
অর্থঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই,তিনি এক তাঁর কোন শরীক নেই,আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসুল। হে আল্লাহ,তুমি আমাকে তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর।
মুখ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য মেসওয়াকের প্রতি যত্নশীল থাকা, যেহেতু কিছুক্ষণ পরেই সালাতে তেলাওয়াত করা হবে পবিত্র কালাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘তোমরা কোরআন পড়ার জন্য মুখ ধৌত কর।’’ ( বর্ণনায় বায্যার)
সুন্দর পোষাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে পরিপাটি হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘‘ও বনি আদাম, তোমরা প্রতি সালাতের সময় সাজ-সজ্জা গ্রহণ কর।’’ (সূরা আল আরাফ: ৩১)
আল্লাহর জন্য পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করা অধিক শ্রেয়। কারণ, পরিস্কার পরিচ্ছদ ও সুগন্ধির ব্যাবহার নামাজির অন্তরে প্রফুল্লতার সৃষ্টি করে। যা শয়নের কাপড় কিংবা নিম্নমানের কাপড় দ্বারা সম্ভব নয়। তদ্রুপ সালাতের প্রস্তুতি স্বরূপ, শরীরের জরুরি অংশ ঢেকে নেয়া, জায়গা পবিত্র করা, জলদি সালাতের জন্য তৈরী হওয়া ও ধীর স্থিরভাবে মসজিদ পানে চলা।আঙ্গুলের ভেতর আঙ্গুল দিয়ে অলসতার অবস্থা পরিহার করা। সালাতের জন্য অপেক্ষা করা। মিলে মিলে এবং কাতার সোজা করে দাড়ানো। কারণ, শয়তান কাতারের মাঝখানে ফাঁকা জায়গাতে আশ্রয় নেয়।
দুই : স্থিরতা অবলম্বন করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি অঙ্গ স্বীয় স্থানে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন।
সালাতে ভুলকারী ব্যক্তিকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘‘এভাবে না পড়লে তোমাদের কারো সালাত শুদ্ধ হবে না।’
আবু কাতাদা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘সালাতে যে চুরি করে, সেই সবচে নিকৃষ্ট চোর। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল সালাতে কীভাবে চুরি করে ? তিনি বললেন, রুকু-সেজাদ ঠিক ঠিক আদায় করে না।’’ ( আহমাদ ও হাকেম)
আবু আব্দুল্লাহ আশআরি রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‘‘যে ব্যক্তি রুকু অসর্ম্পর্ণ রাখে আর সেজাদাতে শুধু ঠোকর মারে, সে ঐ খাদকের মত যে দুই-তিনটি খেজুর খেল অথচ কোনো কাজে আসল না।’’ ( তাবরানি)
ধীরস্থিরতা ছাড়া খুশু সম্ভব নয়। কারণ, দ্রুত সালাতের কারণে খুশু নষ্ট হয়। কাকের মত ঠোকর মারার কারণে, সাওয়াব নষ্ট হয়।
তিন : সালাতে মৃত্যুর স্মরণ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তুমি সালাতে মৃত্যুর স্মরণ কর। কারণ, যে সালাতে মৃত্যুর স্মরণ করবে, তার সালাত অবশ্যই সুন্দর হবে। এবং সে ব্যক্তির ন্যায় সালাত পড়, যাকে দেখেই মনে হয়, সে সালাতে আছে।’’ (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহিহাহ)
আবু আইউব রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপদেশ দিয়ে বলেন,
‘‘যখন সালাতে দাড়াবে, মৃত্যুমুখী ব্যক্তির ন্যায় দাঁড়াবে।’’ (আহমদ)
মৃত্যু প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নিশ্চিত। কিন্তু তার সময়-ক্ষণ অনিশ্চিত। তাই শেষ সালাত চিন্তা করলে এ সালাতই এক বিশেষ ধরনের সালাতে পরিণত হবে। হতে পারে এটাই জীবনের শেষ সালাত।
চার : পঠিত আয়াত ও দোয়া-দরূদে ফিকির করা, ও গভীর মনোযোগ দিয়ে তা অনুধাবন করার চেষ্টা করা এবং সাথে সাথে প্রভাবিত হওয়া। কারণ, কোরআন নাজিল হয়েছে মূলত: চিন্তা-ফিকির ও গবেষণা করার জন্যই। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘‘জ্ঞানীদের উপদেশ গ্রহণ ও গবেষণার জন্য আমি একটি মোবারক কিতাব আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি।’’ (সূরা সাদ: ২৯)
আর এর জন্য প্রয়োজন পঠিত আয়াতের অর্থানুধাবন, উপদেশ গ্রহণ করণ ও জ্ঞানার্জন। তবেই সম্ভব- গবেষণা, অশ্রু ঝরানো ও প্রভাবিত হওয়া। আল্লাহ তাআলা রহমানের বান্দাদের প্রসংশা করে বলেন,
আর যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিলে অন্ধ ও বধিরদের মত পড়ে থাকে না। (সূরা আল ফোরকান: ৭৩)
এর দ্বারাই বুঝে আসে তাফসিরের গুরুত্ব। ইবনে জারির রহ. বলেন, ‘‘আমি আশ্চর্য বোধ করি, যে কোরআন পড়ে অথচ তাফসির জানে না, সে কিভাবে এর স্বাদ গ্রহণ করে।’’ (মাহমূদ শাকের কর্তৃক তাফসিরে তাবারির ভূমিকা: ১/১০)
গবেষণার আরো সহায়ক, বার বার একটি আয়াত পড়া এবং পুনঃপুনঃ তার অর্থের ভেতর চিন্তা করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমল এরূপই ছিল। বর্ণিত আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
“(আজ)তাদের অপরাধের জন্য তুমি যদি তাদের শাস্তি দাও(দিতে পার),কারণ তারা তো তোমারই বান্দা,আর তুমি যদি তাদের ক্ষমা করে দাও(তাও তোমার মর্জি),অবশ্যই তুমি হচ্ছ বিপুল ক্ষমতাশালী প্রজ্ঞাময়।“[আল-মায়িদাহঃ১১৮]
আয়াতটি পড়তে পড়তে রাত শেষ করে দিয়েছিলেন। ( ইবন খুযাইমা ও আহমাদ)
আয়াতের তেলাওয়াতের সাথে সাথে প্রভাবিত হওয়াও চিন্তার সহায়ক। হুজায়ফা রা. হতে বর্ণিত,
‘‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কোনো এক রাতে সালাত পড়েছি। লক্ষ্য করেছি, তিনি একটি একটি করে আয়াত পড়ছিলেন। যখন আল্লাহর প্রশংসামূলক কোনো আয়াত আসতো, আল্লাহর প্রশংসা করতেন। যখন প্রার্থনা করার আয়াত আসতো, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। যখন আশ্রয় চাওয়ার আয়াত আসতো, আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতেন।’’ (সহিহ মুসলিম : ৭৭২)
আরেকটি বর্ণনায় আছে, ‘‘আমি এক রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সালাত পড়েছি। তার নিয়ম ছিল,রহমতের কোনো আয়াত আসলে, আল্লাহর কাছে রহমত চাইতেন। শাস্তির আয়াত আসলে আল্লাহর নিকট শাস্তি হতে পানাহ চাইতেন। আল্লাহর পবিত্রতার আয়াত আসলে, আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করতেন।’’ (তাজিমু কাদরিস সালাত: ১/৩২৭)
এ ঘটনাগুলো তাহাজ্জুতের সালাতের ব্যাপারে।
সাহাবি কাতাদা ইবনে নুমান এর ঘটনা, ‘‘তিনি এক রাতে সালাতে দাঁড়িয়ে, বার বার শুধু সূরায়ে এখলাস পড়েছেন। অন্য কোন সূরা পড়েননি।’’ (বোখারি - ফতহুল বারি : ৯/৫৯, আহমাদ : ৩/৪৩)
সালাতে তেলাওয়াত ও চিন্তা-ফিকির করার জন্য কোরআন হিফজ করা এবং সালাতে পড়ার দোয়া-দরূদ মুখস্থ করাও একাগ্রতা অর্জনে সহায়ক।
তবে নিশ্চিত, কোরআনের আয়াতে চিন্তা-গবেষণা করা এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হওয়া একাগ্রতা অর্জনের জন্য বড় হাতিয়ার। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’। (সূরা ইসরা : ১০৯)
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বর্ণনা করছি, যার দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাতে চিন্তা, একাগ্রতা এবং কোরআনের আয়াতে গবেষণার চিত্র ফুটে উঠবে, আরো ফুঠে উঠবে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা। তাবিয়ী রহ. বলেন, আমি এবং উবাইদ ইবনে ওমায়ের আয়েশা রা.-এর নিকটি গমন করি। উবাইদ আয়েশাকে অনুরোধ করলেন, আপনি আমাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি অতি আশ্চর্য ঘটনা শুনান। আয়েশা রা. এ কথা শুনে কেঁদে ফেললেন, অতঃপর বললেন, এক রাতে উঠে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আয়েশা তুমি আমাকে ছাড়, আমি আমার প্রভুর ইবাদত করি। আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমি আপনার নৈকট্য পছন্দ করি এবং আপনার পছন্দের জিনিসও পছন্দ করি। আয়েশা রা. বলেন, তিনি উঠে ওজু করলেন এবং সালাতে দাড়ালেন। আর কাঁদতে আরাম্ভ করলেন। কাঁদতে কাঁদতে বক্ষ ভিজে গেল। আরো কাঁদলেন, কাঁদতে কাঁদতে মাটি পর্যন্ত ভিজে গেল। বেলাল তাঁকে (ফজরের) সালাতের সংবাদ দিতে এসে দেখেন, তিনি কাঁদছেন। বেলাল বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কাঁদছেন! অথচ আল্লাহ আপনার আগে-পরের সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন ? রাসূল বললেন, আমার কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হতে মনে চায় না?আজ রাতে আমার উপর কয়েকটি আয়াত অবর্তীণ হয়েছে, যে এগুলো পড়বে আর এতে চিন্তা ফিকির করবে না, সে ক্ষতিগ্রস্ত।
সুরায়ে ফাতেহার পর আমিন বলাও আয়াতের সাথে সাথে প্রভাবিত হওয়ার একটি নমুনা। এর সাওয়াবও অনেক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যখন ইমাম আমিন বলে, তোমরাও আমিন বল। কারণ, যার আমিন ফেরেস্তাদের আমিনের সাথে মিলবে, তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’’ ( সহিহ বুখারি : ৭৪৭)
তদ্রুপ ইমামের “সামি আল্লাহু লিমান হামিদাহ”এর জায়গায় মুক্তাদির، “রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ” বলা। এতেও রয়েছে অনেক সাওয়াব। রেফাআ জারকি রা. বলেন, আমরা একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পেছনে সালাত পড়ছিলাম। যখন তিনি রুকু হতে“সামি আল্লাহু লিমান হামিদাহ” বলে মাথা উঠালেন, পিছন থেকে একজন বলল,”রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদু,হামাদান কাছীরান তায়্যিবান মুবা-রাকান ফীহি” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শেষ করে বললেন, কে বলেছে? সে বলল আমি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ত্রিশজনেরও বেশি ফেরেশতাদের লক্ষ্য করেছি, এর সাওয়াব লেখার জন্য দৌড়ে ছুটে আসছে। কে কার আগে লিখবে। ( বোখারি, ফাতহুল বারি ২/২৮৪)
চলবে ইনশাআল্লাহ্।
লেখকঃ সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদানা : ইকবাল হোছাইন মাছুম
No item in cart.