সালাতে একাগ্রতা ও খুশু পর্ব-৩
পাঁচ : প্রতিটি আয়াতের মাথায় ওয়াকফ করে করে পড়া। এ পদ্ধতি চিন্তা ও বোঝার জন্য সহায়ক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নতও বটে। উম্মে সালামা রা. বলেন,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোরআন তেলাওয়াতের ধরন ছিল, প্রথমে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” পড়তেন। এর পর ওয়াকফ করতেন। অতঃপর পড়তেন “আল’হামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামিন” এরপর ওয়াকফ করতেন। অতঃপর পড়তেন, “আর রাহমানির রাহীম” এর পর ওয়াকফ করতেন।অতঃপর পড়তেন, “মালিকি ইয়াওমিদ্দিন”এভাবে এক একটি আয়াত ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়তেন।
رواه أبوداود رقم (৪০০১) وصححه الألباني في الإرواء وذكر طرقه (২/৬০).
প্রতি আয়াতের মাথায় ওয়াকফ করা সুন্নত। যদিও পরবর্তী আয়াতের সাথে অর্থের মিল থাকে।
ছয় : সুন্দর আওয়াজে তারতিল তথা ধীর গতিতে পড়া। আল্লাহ তাআলা বলেন,
আর স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কোরআন আবৃত্তি কর। (আল-মুজ্জাম্মেল : ৪)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তেলাওয়াতও ছিল, একটি একটি অক্ষর করে সুবিন্যস্ত।
مسند إمام أحمد (৬/২৯৪) بسند صحيح صفة الصلاة، ص ১০৫.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারতিল সহকারে সূরাগুলো তেলাওয়াত করতেন। একটি লম্বা সূরার তুলনায় পরবর্তী সুরাটি আরো লম্ব হত। ( সহিহ মুসলিম : ৭৩৩)
তারতিলের সাথে ধীরগতির পড়া খুশু ও একাগ্রতার সহায়ক। যেমন তাড়াহুড়ার সাথে দ্রুত গতির পড়া একাগ্রতার প্রতিবন্ধক। সুন্দর আওয়াজে তেলাওয়াত করাও একাগ্রতার সহায়ক।যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপদেশ
‘‘তোমরা সুন্দর আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াত কর। কারণ, সুন্দর আওয়াজ কোরআনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়।’’ (আল-হাকেম : ১/৫৭৫, সহিহ আল-জামে : ৩৫৮১)
তবে সাবধান! সুন্দর আওয়াজে পড়ার অর্থ অহংকার কিংবা গান-বাজনার ন্যায় ফাসেক-ফুজ্জারদের মত আওয়াজে নয়। এখানে সৌন্দর্যের অর্থ চিন্তার গভীরতাসহ সুন্দর আওয়াজ।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘সবচে’ সুন্দর আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াতকারী ঐ ব্যক্তি যার তেলাওয়াত শুনে মনে হয় সে আল্লাহকে ভয় করছে।’’ (ইবনে মাজাহ : ১/১৩৩৯, সহিহ আল-জামে : ২২০২)
সাত : মনে করা আল্লাহ তাআলা সালাতের ভেতর তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি সালাতকে আমার এবং আমার বান্দার মাঝে দু’ভাগে ভাগ করেছি। আমার বান্দা যা চাবে তা পাবে। যখন আমার বান্দা বলে,
“আল’হামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামিন” (সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি সকল জগতের রব) আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল যখন বলে, “আর রাহমানির রাহীম” ( পরম দয়ালু অতীব মেহেরবান) আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার গুণগান করল যখন বলে, “মালিকি ইয়াওমিদ্দিন”( বিচার-প্রতিদান দিবসের মালিক)আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার বান্দা আমার যথাযথ মর্যাদা দান করল যখন বলে, “ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকানাস্তাইন”( আমরা কেবল আপনারই ইবাদত করি, কেবল আপনার কাছেই সাহায্য চাই) আল্লাহ তাআলা বলেন,এটি আমি ও আমার বান্দার মাঝে, আর আমার বান্দা যা প্রার্থনা করবে, পাবে। যখন বলে, “ইহদিনাস সিরাতল মুস্তাক্বিম,সীরাত্বল্লাযীনা আন আমতা ‘আলাইহিম, গ্বাইরিল মাগদুবি আলাইহিম, ওয়ালাদ্ব---লীন” ( আমাদের সরল পথ দেখান, তাদের পথ, যাদের উপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন। যাদের উপর (আপনার) ক্রোধ নিপতিত হয়নি এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়নি) আল্লাহ তাআলা বলেন,. ( এটা আমার বান্দার জন্য, আর আমার বান্দা যা প্রার্থনা করবে পাবে) (সহিহ মুসলিম : ৩৯৫)
হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো নামাজি এর অর্থ ধ্যানে রাখলে সালাতে চমৎকার একাগ্রতা হাসিল হবে। সূরা ফাতেহার গুরুত্বও প্রনিধান করবে যতেষ্টভাবে। যেহেতু সে মনে করছে,আমি আল্লাহকে সম্বোধন করছি, আর তিনি আমার কথার উত্তর দিচ্ছেন। সুতারাং এ কথপোকথনের যথাযথ মূল্যায়ন করা একান্ত কর্তব্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘তোমাদের কেউ সালাতে দাড়ালে সে, মূলত: তার রব-আল্লাহর সাথে কথপোকথন করে। তাই খেয়াল করা উচিত কিভাবে কথপোকথন করছে।’’
مستدرك الحاكم (১/২৩৬) وهو في صحيح الجامع رقم (১৫৩৮).
আট : সামনে সুতরা রেখে সালাত আদায় করা এবং সুতরার কাছাকাছি দাড়ানো। এর দ্বারাও সালাতে একাগ্রতা অর্জন হয়। দৃষ্টি প্রসারিত হয় না, শয়তান থেকে হেফাজত এবং মানুষের চলাচল থেকেও নিরাপদ থাকা যায়। অথচ এ সকল জিনিস দ্বারাই সালাতে অন্যমস্কতার সৃষ্টি হয়, সাওয়াব কমে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘তোমাদের কেউ যখন সালাত পড়বে, সামনে সুতরা নিয়ে নেবে এবং তার নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়াবে।’’ (আবু দাউদ : ১৬৯৫/৪৪৬,সহিহ আল-জামে : ৬৫১)
সুতরার নিকটবর্তী হয়ে দাড়ানোতে অনেক উপকার নিহিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘যখন তোমাদের কেউ সুতরার সামনে সালাত পড়বে, সুতরার নিকটবর্তী হয়ে দাড়াবে।’’(আবু দাউদ : ১৬৯৫/৪৪৬, সহিহ আল-জামে : ৬৫১)
যাতে শয়তান তার সালাত নষ্ট না করতে পারে। সুতরার নিকটবর্তী হওয়ার সুন্নত তরিকা হলো, সুতরা এবং তার মাঝখানে তিন হাত ব্যবধান রাখা। সুতরা এবং সেজদার জায়গার মাঝখানে একটি বকরি যাওয়ার মত ফাক রাখা। (বোখারি -ফতহুল বারি : ১/৫৭৪, ৫৭৯)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও নির্দেশ দিয়েছেন, কেউ যেন সুতরার সামনে দিয়ে যেতে কাউকে সুযোগ না দেয়। তিনি বলেন, ‘‘যখন তোমাদের কেউ সালাত আদায় করে, সালাতের সম্মুখ দিয়ে কাউকে যাওয়ার সুযোগ দিবে না। যথাসাধ্য তাকে প্রতিরোধ করবে। যদি সে অস্বীকার করে তবে তাকে হত্যা করবে। কারণ, তার সাথে শয়তান। ( সহিহ মুসলিম : ১/২৬০, সহিহ আল-জামে : ৭৫৫)
ইমাম নববি রহ. বলেন, ‘‘সুতরার রহস্য হলো, এর ভেতর দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখা, যাতায়াত বাধাগ্রস্থ করা, শয়তানের চলাচল রুদ্ধ করা। যাতে তার গমনাগমন বন্ধ হয়, সালাত নষ্ট করার সুযোগ না পায়। (সহিহ মুসলিম এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ : ৪/২১৬)
নয় : ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাতে দাড়াতেন, ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা হলাম নবীদের জমাত। আমাদেরকে সালাতে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।’’
رواه الطبراني في معجم الكبير رقم (১১৪৮৫) قال الهيثمي: رواه الطبراني في الأوسط ورجاله رجال الصحيح، المجمع(৩/১৫৫).
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘‘সালাতের ভেতর এক হাতের উপর আরেক হাত রাখার মানে কি? তিনি বলেন, এটি মহান আল্লাহর সামনে বিনয়াবনত অবস্থা।’’
الخشوع في الصلاة، ابن رجب ص : ২১.
ইবনে হাজার রহ. বলেন, আলেমগণ বলেছেন, ‘‘এটি অভাবী-মুহতাজ লোকদের যাঞ্চনা করার পদ্ধতি। দ্বিতীয়ত: এর কারণে অহেতুক নড়া-চড়ার পথ বন্ধ হয়, একাগ্রতা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। (ফতহল বারি : ২/২২৪)
দশ : সেজদার জায়গায় দৃষ্টি রাখা। আয়েশা রা. হতে বর্ণিত,
‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের সময় মাথা অবনত রাখতেন এবং দৃষ্টি দিতেন মাটির দিকে।’’
رواه الحاكم (১/৪৭৯) وقال : صحيح على شرط الشيخين، ووافقه الألباني صفة الصلاة ص : ৮৯.
‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা ঘরে প্রবেশ করে, বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেজদার জায়গাতেই দৃষ্টি নিবন্ধ রেখেছেন।’’ رواه الحاكم في المستدرك(১/৪৭৯)وقال صحيح على شرط الشيخين، ووافقه الذهبي، قال الألباني: وهو كما قالا، إرواء الغليل (২/৭৩)
যখন তাশাহুদের জন্য বসবে, তখন শাহাদাত আঙ্গুলের প্রতি দৃষ্টি রাখবে। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত, ‘‘তিনি যখন তাশাহুদের জন্য বসতেন, শাহাদাত আঙ্গুলের মাধ্যমে কিবলার দিকে ইশারা করতেন এবং সে দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখতেন।’’
رواه ابن خزيمة (১/৩৫৫ رقم ৭১৯) وقال المحقق : إسناده صحيح، وانظر صفة الصلاة ص: ১৩৯.
অন্য আরেকটি বর্ণনায় আছে, ‘‘তিনি শাহাদাত আঙ্গুলের মাধ্যমে ইশারা করেছেন। আর দৃষ্টি এ ইশারা অতিক্রম করেনি।’’رواه أحمد (৪/৩)، وأبو داود رقم (৯৯০).
একটি মাসআলা : অনেক নামাজির অন্তরে ঘোরপাক খায়, সালাতে চোখ বন্ধ রাখার বিধান কি? বিষেশত: এর দ্বারা অনেকে অধিক একাগ্রতাও উপলব্ধি করেন।
উত্তর : চোখ বন্ধ রাখা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত সুন্নত এর খেলাফ। যা পূর্বের বর্ণনাতে স্পষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয়ত: এর দ্বারা সেজদার জায়গা ও শাহাদাত আঙ্গুলের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার সুন্নত ছুটে যায়। আরো অনেক হাদিস বর্ণিত আছে, যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে চোখ খোলা রাখতেন। যেমন,সালাতে কুছুফে জান্নাত দেখে ফলের থোকা ধরার জন্য হাত প্রসারিত করা, জাহান্নাম দেখা, বিড়ালের কারণে শাস্তি ভোগকারী নারীকে দেখা, লাঠির আঘাতে শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তিকে দেখা,সালাতের সামনে দিয়ে অগ্রসরমান জানোয়ার ফিরানো, তদ্রুপ শয়তানের গলা চিপে ধরা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ্য করা এসব ঘটনা ছাড়াও আরো ঘটনা আছে, যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় সালাতে চোখ বন্ধ রাখা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ নয়।
তবে চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ কি-না এ ব্যাপারে আলেমদের মতদ্বৈততা আছে। ইমাম আহমদসহ অনেকে বলেছেন, এটি ইহুদিদের আমল, সুতরাং মাকরূহ। অপর পক্ষ বলেছেন, এটি বৈধ,মাকরূহ নয়।... সঠিক উত্তর হলো, যদি চোখ খোলা রাখার কারণে, একাগ্রতায় কোনো বিঘœতা সৃষ্টি না হয়, তবে খোলা রাখাই উত্তম। আর যদি মসজিদের অঙ্গ-সজ্জা কিংবা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে একাগ্রতাতে বেঘাত সৃষ্টি হয়, তাহলে চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ হবে না। বরং এ ক্ষেত্রে শরয়ি নিয়ম-কানুনের দৃষ্টিকোণ থেকে চোখ বন্ধ রাখা মোস্তাহাব হিসেবেই বিবেচিত। সংক্ষিপ্ত : যাদুল মাআদ(১/২৯৩) ط. دار الرسالة.
মুদ্দা কথা, সালাতে চোখ খোলা রাখাই সুন্নত। তবে একাগ্রতায় বিঘœতা সৃষ্টিকারী বস্তু হতে হেফাজতের জন্য চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ নয়।
এগারো : শাহাদাত আঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করা। অধিকাংশ নামাজি এর ফজিলত ও একাগ্রতা সৃষ্টিতে এর ভূমিকা কত বেশি তা তো জানেই না, উল্টো একে ছেড়ে দিয়েছে একেবারে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘লোহার তুলনায় এর আঘাত শয়তানের উপর অধিক কষ্টদায়ক।’’
رواه الإمام أحمد (২/১১৯) بسند حسن كما في صفة الصلاة ص : ১৫৯.
কারণ, এর দ্বারা বান্দার মনে আল্লাহর একত্ব ও ইখলাসের কথা স্মরণ হয়। যা শয়তানের উপর বড়ই পিড়াদায়ক। الفتح الرباني للساعاتي (৪/১৫).
চলবে ইনশাআল্লাহ্।
লেখকঃ সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনাঃ ইকবান হোছাইন মাছুম
No item in cart.