মসজিদের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ আদব
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন - তারাই তো আল্লাহর মসজিদ আবাদ করে, যারা ঈমান আনে, আল্লাহ ও আখেরাতে এবং সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেও ভয় করে না। অতএব আশা করা যায়, তারা হবে সৎপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। [ সূরা তাওবা: ১৮]
প্রিয় ভাইয়েরা, মুসলিম হিসেবে মসজিদের সাথে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। প্রতিদিন আমাদেরকে ৫বার মসজিদে নামাযের উদ্দেশ্যে যেতে হয়। তাই মসজিদ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমাদের জানা থাকা দরকার। কিছু বিষয়ে আমাদের সচেতনতা দরকার। তাই নিম্নে কুরআন ও হাদীসের আলোকে মসজিদের কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ আদব উল্লেখ করা হল। আশা করি বিষয়টি আমাদের মসজিদ সম্পর্কে আরও যত্নশীল ও সচেতন হবে সাহায্য করবে ইনশা'আল্লাহ।
১. মসজিদ তৈরি করার মর্যাদা:
রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিভিন্ন স্থানের প্রয়োজন অনুসারে মসজিদ তৈরি করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ তৈরি করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করবেন।” (সহীহ মুসলিম)
২. আযান শুনে নামায পড়ার আগে মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়:
আজান হওয়ার পর বৈধ ওজর ব্যতীত মসজিদ থেকে বাইরে যাওয়া যায়েজ নয়। রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “আজান শোনার পর যে ব্যক্তি মসজিদ থেকে বিনা প্রয়োজনে বের হয় এবং পুনরায় মসজিদে ফিরে আসার তার ইচ্ছাও নাই সে মুনাফিক।” (ইবনে মাজাহ)
৩. মসজিদকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা খুবই মর্যাদা পূর্ণ কাজ:
শরীয়তে মসজিদকে পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে তাগিদ এসেছে। হযরত আবু হারায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, জনৈক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা মসজিদে নববী পরিষ্কারের কাজ করত। কয়েক দিন থেকে রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে দেখতে না পেয়ে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, “মহিলাটির কি হয়েছে?” বলা হল: সে মারা গেছে, অতঃপর তাকে দাফন করা হয়েছে। তিনি বললেন: তোমরা আমাকে সংবাদ দিলে না কেন? কোথায় তার কবর? অতঃপর তিনি তার কবরের কাছে গিয়ে তার জানাজা পড়লেন। (সহীহ বুখারী, মুসলিম,ইবনে মাজাহ)
উল্লেখ্য যে, কবরে গিয়ে মহিলার জন্য রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায পড়ার ব্যাপারটি শুধু তাঁর জন্যই খাস। অন্য কারও জন্য প্রযোজ্য নয়।
৪. মসজিদের ভেতর কফ, থুথু ময়লা ইত্যাদি ফেলা নাজায়েজ:
একবার রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদের সামনের দিকে এক লোককে কফ দেখলেন। তখন তিনি বললেন: কি ব্যাপার? তোমাদের মধ্যে কোন কোন লোক তার প্রভুর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর সামনে থুথু নিক্ষেপ করে। সে কি এটা পছন্দ করে যে তার সামনে এসে তার মুখে থুথু নিক্ষেপ করা হোক? যদি থুথু নিক্ষেপ করতেই হয় তবে বাম পয়ের নিচে ফেলবে অথবা এই ভাবে কাপড়ে তা নিক্ষেপ করবে। আবু হুরিরা বলেন: আমি দেখলাম, (শিক্ষা দেয়ার জন্য) তিনি কাপড়ের এক অংশে থুথু ফেলে অন্য অংশ দিয়ে তা ডলে দিলেন।) (সহীহ মুসলিম)
৫. মসজিদে বেচা- কেনা করা, হারানো বস্তু খোঁজ করা বা সে ব্যাপারে ঘোষণা দেয়া বৈধ নয়: রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যখন তোমরা কোন ব্যক্তিকে মসজিদে কেনা-বেচা করতে দেখবে তখন তার জন্য বদ দোয়া করে বলবে: আল্লাহ তোমার ব্যবসায় লোকসান দিক। আর কাউকে যদি হারানো বস্তু মসজিদে এসে খুঁজতে দেখ বা সে সম্পর্কে ঘোষণা দিতে দেখ। তবে বলবে আল্লাহ করুন বস্তুটি তুমি যেন খুঁজে না পাও। (তিরমিযী, নাসাঈ)
৬. মসজিদে এসে বা নামাজের অপেক্ষায় বসে থাকার সময় এক হাতের আঙ্গুলগুলো অন্য হাতের আঙ্গুলের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে বসে থাকা নিষেধ: রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “তোমাদের কেউ বাড়িতে ওযু করে মসজিদে এলে বাড়ি ফিরে যাওয়া পর্যন্ত সে যেন নামাজ রত থাকল।” তারপর তিনি বললেন: “কেউ মসজিদে এসে যেন এরূপ করে না বসে।” তারপর তিনি তাঁর এক হাতের আঙ্গুল গুলো অন্য হাতের আঙ্গুলগুলোর ফাঁকে প্রবেশ করিয়ে দেখালেন। (ইবনে খুযাইমা ও হাকেম)
৮.কাঁচা পিয়াজ বা কাঁচা রসুন খেয়ে অথবা দুর্গন্ধ নিয় মসজিদে প্রবেশ করতে নিষেধ:
রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাঁচা পিয়াজ বা কাঁচা রসুন খেয়ে অথবা দুর্গন্ধ নিয় মসজিদে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা বনী আদম যে বিষয়ে কষ্ট অনুভব করে ফিরিশতাগণ তা থেকে কষ্ট অনুভব করেন। হাদীসে এরশাদ হচ্ছে: দুর্গন্ধময় এই দুটি সবজি (কাঁচা পেয়াজ ও কাঁচা রসূন) খেয়ে তোমরা মসজিদে প্রবেশ করা থেকে সাবধান। যদি খেতেই হয় তবে আগুনের সাহায্যে এগুলোর দুর্গন্ধ ধ্বংস করে নিবে। (ত্ববরানী)
৯.আল্লাহর নিকট পৃথিবীর সর্বোত্তম স্থান হল মসজিদ সমূহ:
রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “আল্লাহর নিকট সবচেয় পছন্দনীয় স্থান হচ্ছে মসজিদ সমূহ। আর তার নিকট সব চেয়ে অপছন্দনীয় স্থান হচ্ছে বাজার সমূহ।” (সহীহ মুসলিম)
১০.মসজিদে গমন কারীর জন্য প্রতিটি পদক্ষেপে একটি করে সওয়াব দেয়া হয় এবং একটি করে পাপ মোচন হয়:
মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি জামাতে নামায পড়ার উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করে, তার প্রতিটি পদক্ষেপে একটি করে পাপ মোচন হয়, দ্বিতীয় পদক্ষেপে একটি সোওয়াব লিপিবদ্ধ হয়। মসজিদে গমন এবং প্রত্যাবর্তন উভয় অবস্থায় এই প্রতিদান পাওয়া যায়। (আহমদ ও ত্ববরানী)
১১.কবরস্থানে মসজিদ তৈরি করা কিংবা মসজিদে কবর বানানো হারাম:
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আল্লাহ তাআ’লার অভিশাপ ইহুদি ও খৃষ্টানদের উপর তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে। [ বুখারী ও মুসলিম ]
জুন্দুব (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পূর্বে পাঁচটি অসিয়ত শুনেছেন, তন্মধ্যে একটি হল কবরকে মসজিদে রূপান্তরিত করা বিষয়ে হুঁশিয়ারি। বর্ণনায় এসেছে -
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন তোমাদের পূর্ববর্তীরা নবী ও সৎ লোকদের কবরকে মসজিদ বানাতো। সাবধান! তোমরা কবরকে মসজিদ বানিও না। আমি তোমাদেরকে এ থেকে নিষেধ করছি। কবরস্থানে জানাজার সালাত ব্যতীত অন্য কোন সালাত বৈধ নয়। [ মুসলিম]
১২.মসজিদে ধীরে-সুস্থে ও শান্তভাবে যাওয়া। তাড়াতাড়ি বা দৌড়িয়ে না যাওয়া:
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
যখন তোমরা সালাতে আসবে অবশ্যই ধীরস্থিরতা বজায় রাখবে । যে-টুকু পাবে আদায় করবে। আর যে-টুকু পাবেনা তা পূর্ণ করবে। [বুখারী : হাদীস নং ৫৯৯]
১৩. মসজিদে আগে যাওয়া এবং প্রথম কাতারে সালাত আদায়ের প্রতি আগ্রহী থাকা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করে বলেছেন :
যদি মানুষ জানতে পারত, আযান এবং প্রথম কাতারে সালাত আদায়ের মধ্যে কি ফজিলত, আর তা লটারি ব্যতীত অর্জন করা সম্ভব না হত, তবে তার জন্য লোকেরা অবশ্যই লটারি করত। আর যদি জানতে পারত মসজিদে আগে আসার মধ্যে কি ফযীলত, তাহলে তার জন্য প্রতিযোগিতা করে আসত। [বুখারী : হাদীস নং ৬১৫]
আর যিনি মসজিদে আগে আসবেন, কোনো কারণ ছাড়া তার প্রথম কাতার বাদ দেয়া উচিত নয়। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ বলেন,
যে ব্যক্তি আগে আসল এবং প্রথম কাতার বাদ দিয়ে বসল, সে শরীয়তের বিধান লঙ্ঘন করল।
সালাতে দেরি করে আসার দ্বারা বড় কল্যাণ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :তোমরা আগে এসো এবং আমার একতেদা করো। আর তোমাদের পরে যারা আসবে তারা তোমাদের পিছনে দাঁড়াবে। যেসব মানুষেরা দেরি করতে থাকবে আল্লাহ্ তাদেরকে পিছিয়ে দিবেন। [মুসলিম : হাদীস নং ৬৬২]
সালাত আদায়ের উদ্দেশে মসজিদে আগে আসার উপকারিতা অনেক — জামাআত প্রথম থেকে পাওয়া, কুরআন তিলাওয়াত ও নফল সালাত আদায়ের সুযোগ। ফেরেশতাদের দোয়া লাভ; কেননা ফেরেশতাগণ এরূপ ব্যক্তির জন্য ক্ষমার দোয়া করতে থাকেন। সালাতের অপেক্ষায় থেকে সালাতের ছাওয়াব অর্জন। কারণ সালাতের অপেক্ষায় বসে থাকা যেন মূল সালাতেই নিমগ্ন থাকা।
১৪. মসজিদে প্রবেশকারী দুই রাকাআত তাহিয়্যাতুল মাসজিদ আদায় ব্যতীত বসবে না:
আবু কাতাদাহ আনসারী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : তোমাদের মধ্যে কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করবে, দুই রাকাত সালাত আদায় না করে সে-যেন না বসে। [মুসলিম : হাদীস নং ১০৯৭]
ইমাম জুমুআর খুৎবা দেয়া অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করলে সংক্ষেপে দুই রাকাত সালাত আদায় করবে। যাবের রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করবে আর ইমাম খুৎবাবস্থায় থাকবেন, তাহলেও যেন দুই রাকাআত সালাত সংক্ষেপে আদায় করে নেয়।
মসজিদে উচ্চস্বরে কথা বলা, সালাতরত ব্যক্তি বা কুরআন পাঠককে বিরক্ত করা মাকরূহ। চাই তা সাধারণ কথা বলার কারণে হোক বা উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করার কারণে হোক। পার্শ্ববর্তীজনকে বরং কষ্ট দেয়াই অপরাধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
সালাত আদাকারী তার প্রভুর সাথে গোপনে কথা বলে। তাই, সে কী বলছে তার প্রতি খেয়াল রাখা উচিত । তোমরা কোরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে একে অন্যের উপর উচ্চ শব্দ করোনা। [আহমাদ:৫০৯৬]
১৫.মসজিদে প্রবেশ করতে ডান পা দিয়ে প্রবেশ করবে। বের হবে বাম পা দিয়ে:
আনাস ( রা.) বলেন : সুন্নত হল যখন মসজিদে প্রবেশ করবে, ডান পা দিয়ে প্রবেশ করবে। আর যখন বের হবে বাম পা দিয়ে বের হবে।
মসজিদে প্রবেশের দোয়া
মসজিদ থেকে বের হবার দোয়া
১৬.মুক্তাদী সর্বদা ইমামের অনুসরণ করবে:
কোনো কার্য ইমামের আগে অথবা একেবারে সাথে সাথে আদায় করবে না। আবার অনেক বিলম্বেও আদায় করবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : ইমাম বানানো হয়েছে তার অনুসরণের জন্য। অতঃপর তোমরা তার সাথে বিরোধ করো না। সে যখন আল্লাহু আকবার বলে তোমরাও আল্লাহু আকবার বলো। সে যখন রুকু করে, তোমরাও রুকুতে যাও । সে যখন سمع الله لمن حمده বলে, তোমরা اللهم ربنا و لك الحمد বলো। সে যখন সেজদা করে, তোমরাও তখন সেজদা করো। যখন বসে সালাত আদায় করে, তোমরাও সকলে বসে সালাত আদায় কর। [ বুখারী : হাদীস নং ৩৬৫]
ইমামের পূর্বে কোন কাজ করা হারাম হওয়া সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
সে ব্যক্তি তার মাথা ইমামের পূর্বে উঠিয়ে ফেলে তার কি এ-ভয় নেই যে আল্লাহ তাআ’লা তার মাথাকে গাধার মাথা বানিয়ে দিবেন কিংবা তার আকৃতিকে গাধার আকৃতি বানিয়ে দিবেন। [মুসলিম : হাদীস নং ৬৪৭]
No item in cart.